খ্যাতির বিড়ম্বনা
একটি লেখা লেখকের পুনর্জন্ম দেয় শতাব্দীর শেষ লগ্নেও তার পাঠকের মনে, তা যেমন সত্য, তেমনই সত্য সময়ের ব্যবধানে সামাজিক ন্যায়নীতি সংক্রান্ত সামাজিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মধ্যেও বিশাল ব্যবধান তৈরি করে দেয় ঐতিহাসিকের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, যে কারণে কার্ল মার্ক্স, যিনি মার্ক্সবাদের জনক, তিনি সারা বিশ্বের বামপন্থীদের কাছে দেবতাতুল্য হলেও আর্জেন্টিনায় আর্জেন্টাইন নাগরিকদের কাছে কুখ্যাত ও নিন্দিত ব্যক্তি হয়ে আছেন, এই কারণে যে তিনি সমকামীদের হত্যা করেছিলেন। বাংলাদেশে যারা কট্টর ধার্মিক বা বামপন্থীদের নাস্তিক বলতেও দ্বিধা করেন না, তারা কিন্তু মার্ক্সের সমকামীদের হত্যা করাকে সমর্থন করেন, যদিও তারা জানেন না এবং জানতে আগ্রহীও নন কোন কারণে মার্ক্স সমকামীদের হত্যা করেছিলেন। ইসলামে সমকামিতা হারাম এবং শুধু এই একটা কারণেই ইসলামিক দেশগুলোতে তরুণ প্রজন্মের কাছে মার্ক্সবাদকে লুকানো হয় না, বরং মার্ক্স যেন হুট করেই জন্মও নিয়েছিলেন এ বাংলায় সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদার নামে, যিনি বিশেষ করে মাওবাদী কমরেড ছিলেন। মাওবাদীদের উগ্র পন্থাকে জঙ্গিবাদ বলে নিষিদ্ধ করে রাখে প্রায় সকল দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রই, কিন্তু মাওবাদই চীনের শিল্প বিপ্লবে প্রাথমিক ভূমিকা রেখেছিল।
অপর দিকে সক্রেটিস হাটে মাঠে ঘাটে জনসাধারণ ও তরুণদের ডেকে জড়ো করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন। সহজ প্রশ্ন, এর উত্তরও সহজ, শুধু একটু ভেবে নিলেই হয়। এই প্রশ্ন-উত্তর, যুক্তি-তর্কের খেলায় জট খুলে যেত অনেক জটিল বিষয়ের, জন্ম নিত ন্যায়নীতির গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, দর্শনের বহুবিধ দৃষ্টি, রাষ্ট্রের জটিল সব সমস্যার সমাধান, আইনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুফল। সক্রেটিসের জ্ঞানের আলো এতই তীব্র ছিল, 'ছেলে বুড়ো সব দল বেঁধে সক্রেটিসের কাছে যেতেন মুক্ত চিন্তায় যুক্ত হয়ে বুদ্ধির নখে শান দিতে'। তাঁর এই সমস্ত কারণে দর্শনে অমর কৃতিত্ব রেখে যেতে পেরেছেন তিনি, কিন্তু তেমন একই কাজ বর্তমান সময়ে করাটা পাগলামি বৈকি আর কিছুর সাক্ষী হবে না। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে, মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ানো তাবলিগদের একটি দল, যারা হাটে মাঠে বাজারে জনসাধারণের সামনে ধর্মের বাণী শোনাতে শোনাতে একটা মুহূর্তে মসজিদে নামাজের জন্য টানাটানি শুরু করেন। অনেকে তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং বেশিরভাগ মানুষই যথেষ্ট বিব্রত ও বিরক্ত হন, তাবলিগের এই কাজটাকে যথেষ্টই অপছন্দও করেন। কিন্তু তাবলিগের এমন প্রথাগত আচরণ পুণ্যের হলেও সময় আর সংস্কৃতির ব্যবধানে একই কাজ যা করেছিলেন পশ্চিমে আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস আর বাংলাদেশে এই যুগে তা করেছেন তাবলিগের হাজার হাজার দল। তফাৎ কেবল সময় আর সংস্কৃতির। আদর্শগত জায়গা থেকে দুটো দর্শনই যেন শাশ্বত, অনন্ত ও ঐশ্বরিক জ্ঞান সমৃদ্ধ, জগৎ খ্যাত অনেক ব্যক্তিত্বরাই সময়ের ব্যবধানে খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়েছেন এভাবেই।
Comments
Post a Comment