যাপনে জীবনের প্রভাব

যাপনে জীবনের প্রভাব
একের পর এক শব্দ লিখছি আর কাটছি, কিন্তু কোনো পূর্ণ বাক্যই গঠন করতে পারিনি, যা আমার লেখায় শব্দ ছন্দের নৃত্যে আশ্চর্য কিছু বোধ জাগাবে। এ যেন লেখকের মনের ভাবের অনেকটা কাছাকাছি, যা সৃজনশীল চিন্তায় শৈল্পিক বিকাশ ঘটাবে। লেখার মতো অনেক বিষয় থাকে, অনেক গল্প থাকে, থাকে অনেক বাক্য, ছন্দ, লয় আর ভাষা। এগুলোই মূলত একটা লেখার প্রাণ, হোক সেটা প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, রচনা কিংবা মতবাদ। খ্যাতির বিড়ম্বনা
একটি লেখা লেখকের পুনর্জন্ম দেয় শতাব্দীর শেষ লগ্নেও তার পাঠকের মনে, তা যেমন সত্য, তেমনই সত্য সময়ের ব্যবধানে সামাজিক ন্যায়নীতি সংক্রান্ত সামাজিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মধ্যেও বিশাল ব্যবধান তৈরি করে দেয় ঐতিহাসিকের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, যে কারণে কার্ল মার্ক্স, যিনি মার্ক্সবাদের জনক, তিনি সারা বিশ্বের বামপন্থীদের কাছে দেবতাতুল্য হলেও আর্জেন্টিনায় আর্জেন্টাইন নাগরিকদের কাছে কুখ্যাত ও নিন্দিত ব্যক্তি হয়ে আছেন, এই কারণে যে তিনি সমকামীদের হত্যা করেছিলেন। বাংলাদেশে যারা কট্টর ধার্মিক বা বামপন্থীদের নাস্তিক বলতেও দ্বিধা করেন না, তারা কিন্তু মার্ক্সের সমকামীদের হত্যা করাকে সমর্থন করেন, যদিও তারা জানেন না এবং জানতে আগ্রহীও নন কোন কারণে মার্ক্স সমকামীদের হত্যা করেছিলেন। ইসলামে সমকামিতা হারাম এবং শুধু এই একটা কারণেই ইসলামিক দেশগুলোতে তরুণ প্রজন্মের কাছে মার্ক্সবাদকে লুকানো হয় না, বরং মার্ক্স যেন হুট করেই জন্মও নিয়েছিলেন এ বাংলায় সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদার নামে, যিনি বিশেষ করে মাওবাদী কমরেড ছিলেন। মাওবাদীদের উগ্র পন্থাকে জঙ্গিবাদ বলে নিষিদ্ধ করে রাখে প্রায় সকল দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রই, কিন্তু মাওবাদই চীনের শিল্প বিপ্লবে প্রাথমিক ভূমিকা রেখেছিল। অপর দিকে সক্রেটিস হাটে মাঠে ঘাটে জনসাধারণ ও তরুণদের ডেকে জড়ো করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন। সহজ প্রশ্ন, এর উত্তরও সহজ, শুধু একটু ভেবে নিলেই হয়। এই প্রশ্ন-উত্তর, যুক্তি-তর্কের খেলায় জট খুলে যেত অনেক জটিল বিষয়ের, জন্ম নিত ন্যায়নীতির গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, দর্শনের বহুবিধ দৃষ্টি, রাষ্ট্রের জটিল সব সমস্যার সমাধান, আইনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুফল। সক্রেটিসের জ্ঞানের আলো এতই তীব্র ছিল, 'ছেলে বুড়ো সব দল বেঁধে সক্রেটিসের কাছে যেতেন মুক্ত চিন্তায় যুক্ত হয়ে বুদ্ধির নখে শান দিতে।' তাঁর এই সমস্ত কারণে দর্শনে অমর কৃতিত্ব রেখে যেতে পেরেছেন তিনি, কিন্তু তেমন একই কাজ বর্তমান সময়ে করাটা পাগলামি বৈকি আর কিছুর সাক্ষী হবে না। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে, মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ানো তাবলিগদের একটি দল, যারা হাটে মাঠে বাজারে জনসাধারণের সামনে ধর্মের বাণী শোনাতে শোনাতে একটা মুহূর্তে মসজিদে নামাজের জন্য টানাটানি শুরু করেন। অনেকে তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং বেশিরভাগ মানুষই যথেষ্ট বিব্রত ও বিরক্ত হন, তাবলিগের এই কাজটাকে যথেষ্টই অপছন্দও করেন। কিন্তু তাবলিগের এমন প্রথাগত আচরণ পুণ্যের হলেও সময় আর সংস্কৃতির ব্যবধানে একই কাজ যা করেছিলেন পশ্চিমে আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস আর বাংলাদেশে এই যুগে তা করেছেন তাবলিগের হাজার হাজার দল। তফাৎ কেবল সময় আর সংস্কৃতির। আদর্শগত জায়গা থেকে দুটো দর্শনই যেন শাশ্বত, অনন্ত ও ঐশ্বরিক জ্ঞান সমৃদ্ধ, জগৎ খ্যাত অনেক ব্যক্তিত্বরাই সময়ের ব্যবধানে খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়েছেন এভাবেই। শক্তির সঞ্চরণ
একটি লেখায় লুকিয়ে থাকেন লেখক স্বয়ং এবং তার চিন্তা, রুচি, যাপনের অবস্থা, জীবনের প্রতি দৃষ্টি, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, শব্দের চয়ন ও ব্যবহার। বাক্যের প্রতিটি গঠনে যেন লুকিয়ে থাকেন লেখকের একেকটি মেজাজের আমেজ, যা পাঠককে হিপনোটাইজ করার মতো আঁকড়ে রাখে পাঠ্যে। জাদুকরী গল্পজালে বন্দি করে জ্ঞানের পথ দেখান লেখক। একটি লেখায় কেবল জ্ঞানই থাকে না, থাকে শিল্পগুণ, প্রাণবন্ততা, প্রাঞ্জলতা, ছন্দ, তাল, গল্প ও জীবন। একটি লেখা-ই যেন একটি ভাস্কর্য, যা হাজারটা দৃষ্টি, চিন্তা ও পরিকল্পনার জন্ম দেয়, দেয় একটা মৌলিক প্রাণের অস্তিত্বও, যেমনটা লেখক চাচ্ছেন। আবার একই লেখা একটি শিল্পও, যা প্রকৃত কোনো অর্থ বহন করে না। বরং এতে আছে একই ভাবের বিশেষ মাত্রা, যেমনটা আমরা সুরের রাগে খুঁজে পাই, যে রাগ ভাবেরই উচ্চ মার্গের প্রকাশ, যে ভাব বিভিন্ন সুরকার বিভিন্ন গানে প্রকাশ ঘটান। শিল্পও বিশেষ কোনো অর্থ বহনে বাধ্য নয়, বাধ্য বরং রাগের একটা মাত্রা বহনে, যে রাগের মাত্রা সমার্থক শক্তি যোগাবে দ্রষ্টার কল্পনার দৃশ্যপটে। ঠিক তেমনই একটি লেখা, যা বিশেষ অর্থ বহন করে না, বহন করে কিছু আত্মার, কিছু শক্তির, কিছু ব্যক্তিত্বের এবং এগুলো একত্রে আমরা আরোহণ করি জ্ঞান বলে। জ্ঞান বিভাজন
কোনো জ্ঞানকে কীভাবে কাজে লাগাবেন তা ব্যক্তির একক ইচ্ছায় আবৃত, সব জ্ঞান সবাইকে একই পথে পরিচালনা করে না। জ্ঞান শুধুমাত্র বুদ্ধির গোঁড়ার খুঁটি শক্ত করে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত, উদাহরণ এবং পরিণতি সংক্রান্ত পাঠ্য দানে, আর এগুলো পুঁজি করে কেউবা রাষ্ট্রের খুঁটি মজবুত করে, আবার কেউবা নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের বীজ বপন করে জনমনে। কেউ হচ্ছেন নন্দিত, কেউবা হচ্ছেন নিন্দিত। খ্যাতির বিড়ম্বনায় সবাই পড়ছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। আমি যা লিখছি তা আমি নই, কেবলই তা আমার ক্ষণিকের ভাবনা মাত্র, প্রবন্ধে আমার প্রকাশ নেই। আমি এখন যা ভাবছি বা লিখছি, একটু পর বিপরীতমুখী ভাবনাও ভাবতে পারি, কোনো ভাবনাই শাশ্বত নয়, বরং প্রত্যেকেই যার যার দিক থেকে স্বতন্ত্র। পরিবার প্রথা
আমাদের একজন বিজ্ঞানী আছেন, ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যার, যিনি জগৎ খ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর সহপাঠী, বন্ধু এবং রুমমেটও ছিলেন। ড. জামাল নজরুল ইসলাম একটি বই লিখেছিলেন "The Ultimate Fate of the Universe" নামে ১৯৮৩ সালে এবং ১৯৮৮ সালে মানে ৫ বছর পর স্টিফেন লিখেন "A Brief History of Time", যা স্টিফেনকে জগৎ বিখ্যাত করেছে। নজরুল ইসলাম স্যারের বড় মেয়ের বিয়েতে স্কটল্যান্ডের একজন বিজ্ঞানী ছিলেন স্যারের বাসায়, তখন ওনার ছোট মেয়ে তার বান্ধবীদের সাথে হারমোনি নিয়ে গান রচনা করছে, হাসি ঠাট্টা করছে, যে দৃশ্যটা খুব গভীরভাবে আবেগাপ্লুত করেছিল স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞানীকে এবং তিনি স্যারকে ডেকে বলছেন, "১০০ বছর আগে আমাদের সংস্কৃতিতে, আমাদের সমাজে, আমাদের জীবন ধারায় এমন অবস্থা ছিল, একসাথে বসে আমরা গান করতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা আমরা স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলেছি।" মূলত, পশ্চিমে আরো ১০০ বছর আগেই হারিয়ে গেছে পরিবার প্রথাটি। এই ভারতীয় উপমহাদেশের পরিবার প্রথা এবং ইসলামিক পারিবারিক আচারে যে ঐতিহ্য এবং সৌহার্দ্য ফুটে ওঠে, তা যেন প্রেমেরই নামান্তর, অপর দিকে পশ্চিমে মুক্ত পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশের প্রতি অনুরাগ এবং টিকে থাকার লড়াই মূলত একটা সময় পারস্পরিক বিশ্বাস, ভরসা বা মায়াময়ী আবেগের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়। পশ্চিমে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ নামে এক প্রকার বিবাহ প্রথার বৈধতা আছে, যা ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে সরাসরি হারাম। জাপানেও দেখা যাচ্ছে পরিবারের প্রতি আগ্রহ, আবেগ বা মায়া তেমন কিছু ঠিক ততটা নেই, যতটা আমরা বাঙালিরা আশা করি, জাপানে বিয়ের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে তরুণদের মাঝে, যা জাপান সরকারেরও মাথা ব্যাথার কারণ। আত্মোৎসর্গ পরিশেষে স্যার নিজের লক্ষ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেশে নিজের পরিবার নিয়ে দেশীয় সংস্কৃতিতে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাবেন বলে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে এবং নিজের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করে। ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যার কাজ করতেন 'কসমোলজি' নিয়ে, যা মহাকাশ বিদ্যার একটা অংশ। কে কখন কী সিদ্ধান্ত নিবেন তা ব্যক্তি কখনো আগে পরিকল্পনা করে রাখেন না, আবার রাখলেও পারিপার্শ্বিক চাপে পরিকল্পনামাফিক সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পারেন না, এ এক অদৃশ্য শক্তিরই যেন প্রভাব, যে শক্তির বলয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে, অস্তিত্ব প্রকাশ করে মন ও আত্মা এবং প্রতিরূপ পায় ভাগ্য, নিয়তি বা কপাল শব্দগুলো। শিক্ষা প্রসঙ্গ
শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই, শিক্ষা সবার জন্য প্রয়োজন। শিক্ষায় শিক্ষিত হবো আমি, শিক্ষায় শিক্ষিত হবে আমার বিবেক, শিক্ষায় শিক্ষিত হবে আমার বোধ, শিক্ষিত হবে আমার আচরণ ও ব্যবহার। তার সাথে শিক্ষায় শিক্ষিত হবে - আমার ভাই, বোন, আমার পরিবার, আমার বন্ধু। শিক্ষায় শিক্ষিত হবে পথে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি, তার ছোট বোন বা বড় ভাইটি। শিক্ষা আমাদের অধিকার সচেতন হতে শেখায়, শিক্ষা আমাদের প্রকৃতিকে জানতে শেখায়, শিক্ষা আমাদের বিবেকে নিজের স্বরূপ বোধ জাগায়, শিক্ষা আমাদের মানবিক হতে শেখায়। শিক্ষা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়, শিক্ষা আমাদের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে, শিক্ষা নন্দনতত্ত্বের কথা বলে। এই পাঠ্য পড়ার মাঝে আপনারা শিক্ষার্থী আছেন, অভিভাবক আছেন, শিক্ষক সমাজের অনেকেই আছেন। এদিকে শিক্ষার্থীদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী অথবা পড়াশোনা করার পর কী হবেন? আপনারা বলবেন, কেউবা শিক্ষক-শিক্ষিকা হবেন, সফল উদ্যোক্তা হবেন, সৎ উকিল হবেন কিংবা আদর্শবান ডাক্তার হবেন। মূলত অর্থনৈতিক মুক্তি কামনায় যখন শিক্ষা গ্রহণ করা হয়, তখন তা একটি জাতির মেরুদণ্ড অপেক্ষা ওই জাতিটার কলঙ্কেরই ধারক বাহক। তার জন্যই শিক্ষা বা পড়াশোনার বিষয়টি শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং বেশ কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছেও নিজস্ব শক্তিবল হারাচ্ছে। শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা আমাদের অধিকার। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো শিক্ষাও আমাদের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা মূলত আপনার জানতে চাওয়ার পিপাসাটুকু মেটাবে। শিক্ষা মূলত আপনাকে যুক্তির কাঠগড়ায় - ন্যায়নীতির সংঘর্ষে প্রশ্নবিদ্ধ করাবে, সত্য আর সুন্দরের প্রত্যাশায়। শিক্ষা নান্দনিক দৃষ্টি দান করে। শিক্ষা অনুভূতি জাগ্রত করে প্রত্যাশিত এক সম্ভাবনায়। শিক্ষা ইতিহাস সচেতন করায়, শিক্ষাই বিপ্লব ঘটায়। ঈশ্বরের মাত্রা দার্শনিক বার্কেলে এক প্রকার ঈশ্বরকে কল্পনা করতেন, যিনি তার অদৃশ্য শক্তির বলয়ে পৃথিবীর সমস্ত কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছেন। প্রথাগত ঈশ্বর নিয়ে কখনো কিছু না বললেও তিনি তাঁর দর্শনে একটি ঈশ্বরকে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন এবং পেরেওছেন, একই রকম ঈশ্বরকে কল্পনা করেছেন ইহুদী লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি। হারারি বলেন, "অনেকগুলো মানুষ যখন কোনো বিষয়ের উপর বিশ্বাসে অটুট, তখন তা অবাস্তবও যদি হয়, তবুও তা সত্য, শাশ্বত", এবং উদাহরণে হারারি বলেন টাকার প্রতি বিশ্বাসের কথা এবং সামাজিকভাবে এর ব্যবহারের প্রতি আমাদের আস্থার কথা। বার্কেলে বলেন, ঈশ্বর হচ্ছেন সকল মনের সমষ্টিগত বিশ্বাস, ওদিকে বার্ট্রান্ড রাসেলের কাছে ঈশ্বর হচ্ছেন "প্রকৃত বস্তুর" নামান্তর মাত্র, যার বিশেষ আদর্শগত বৈশিষ্ট্য থাকবে এবং সকলের সমষ্টিগত মনের উপর নির্ভর করবে, যা হারারির ধারণার সাথে অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে হারারি বলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মনের বিশ্বাসের উপরই নির্ভর করে কোনটা সত্য, কোনটা পবিত্র বা শাশ্বত। আত্মশুদ্ধি আমার বোধগুলো যেন সুন্দরের প্রতি খুব ঋণী। যা দেখি সব যেন ফুটন্ত ফুলের মতো লাগে, প্রেম জাগে, লাগে মায়া, আবেগে আপ্লুত হই যখন সুন্দরকে খুঁজি প্রতিটা প্রাণে, প্রতিটা শিল্পে, প্রতিটা সৃষ্টিতে, প্রতিটা বোধে, প্রতিটা সুখের কাননে। ফুলেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মায়ের কোলে সুন্দর, একটি শাবকের প্রথম হাঁটতে শেখার দৃশ্যটা সুন্দর, সুন্দর একটি অনাহারীর আহার গ্রহণ, একটি শিশুর হাসি মাখা মুখ। সুন্দরকে আমরা ছুঁতে পাই হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে, এবং বোধ থেকে বিচার করি সুখ আর দুঃখকে। সব সুন্দরই সুন্দর হয় না বরং চিরায়ত কিছু সত্য যা সুন্দর হবার কথা, কিন্তু আমাদের বোধে সুন্দর অনুভূতি জাগায় না, উদাহরণে বলা যেতে পারে প্রেমের তরে একটি ফুলের আত্মবিসর্জনের কথা, কোনো শিশুর হাতের খেলনা হয়ে খেলার ছলে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ফুলটার ত্যাগের মহিমান্বিত একটা মর্মান্তিক গল্প, এগুলো মনে সুন্দর বোধ জাগায় না বরং এগুলোকে পৈশাচিক সুখের উপাদান মনে হয়। একটা প্রাণ সে যে সত্ত্বাধিকারী বা গোত্রীয় হোক, সে প্রাণের অনুভূতি সবারই সমান, সবাই তার জীবনের পূর্ণ স্বাদ পেতে চায়, মৃত্যু অনিবার্য হলেও সেটা স্বাভাবিকভাবে হওয়াই সবার প্রত্যাশা, জীবনের মানেটা সবার কাছেই সমান। সাম্যবাদের কথা বলছি, কিন্তু একটা মুহূর্তে বিবেকের কাঠগড়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছি, "সাম্যবাদীতার সমতা বণ্টনে আমি কতটুকু দৃঢ়?" - এই দিক থেকে প্রতিটি প্রাণের প্রতি সমদৃষ্টি আমার দীক্ষিত হবার পথে প্রধান পাথেয় হিসেবে মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করছে। একটি শিশুর মুখের হাসি, একটি ফুলের আগত কলি কিংবা ফলের মুকুল! - সত্যিই এ যেন মধুমাখা সুন্দরের রূপকাশ্রিত পদ। যে সুন্দর দৃষ্টিকে নান্দনিক করে, যে সুন্দর অনুভূতির চর্চা; প্রাণকে উজ্জীবিত করে প্রতিটি সুন্দরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে, এ সত্যিই এক আত্ম-উপলব্ধি ও নিজেকে খুঁজে পাবার প্রকৃত পথ। সুন্দরের বিভৎসতা এবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছি নান্দনিক সুন্দরের পরিবেশগত ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে। পার্কে বসে আছি একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে প্রেমময়ী প্রেয়সীকে বরণ করে নেব বলে, বেঞ্চিতে বসে আছি দুজন, আমি বাদামের খোসা ছুলে জমাচ্ছি তার জন্য, আর সে আপন মনে উদাসীন বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় ফুলগুলোর এক এক পাপড়ি ছিঁড়ে একত্রে জড় করছে, মিষ্টি তার সে হাসি, কত উল্লাস, কত প্রাঞ্জল, কত স্নিগ্ধ সে হাসি। হঠাৎ আমি চমকে উঠি! আমি দেখি অদ্ভুত বিভৎস দেখা যাচ্ছে তার হাসিটা, তার হাতে একটি শিশুর মাথা আর সে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখ থেকে মাংস, চামড়া, চোখ, কান খামচে খামচে ছিঁড়ে নিচ্ছে, আর এই ছেঁড়া মুণ্ডু আমিই এনেছি, প্রেয়সীকে বরণ করে নিতে। কোনো এক জল্লাদ পথে কাটা মুণ্ডু বিক্রি করছে, যার থেকে আমি কিনে এনেছি এই মুণ্ডুখানা, অতঃপর নিজেকে বুঝাতে শুরু করলাম, এ ভ্রম, যা এনেছি তা কেবলই ফুল। কিন্তু এই ফুলের মুগ্ধকর অনুভূতি, এ কি শুধুই অভিনয়? যা মুগ্ধ হবার মতো, তা কীভাবে ধ্বংস করা যায়? যদি যায়, তাহলে এটি কখনো মুগ্ধ হবার বিষয় হতে পারে না। সন্দিহান মনুষ্যত্ব দার্শনিক দেকার্ত এর মতে, "ইন্দ্রিয় যেহেতু ভ্রম দ্বারা বিভ্রান্ত হতে পারে, সেহেতু ইন্দ্রিয়ও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, সেহেতু যুক্তি দিয়ে সত্যান্বেষণ করতে চাইলে বাস্তবতা সম্পর্কে যেকোনো বিশ্বাসকেই সন্দেহ করতে হবে।" আবার সক্রেটিস বলেছেন, "দুনিয়াকে জানার আগে নিজেকে জানতে হবে, যার একমাত্র মাধ্যম হল যৌক্তিক চিন্তা ভাবনা। মানুষের দুটো অংশ থাকে, যার প্রথমটি - দেহ ও দ্বিতীয়টি আত্মা, আত্মায় আবার দুটো অংশ থাকে, এক হচ্ছে অযৌক্তিকতা, যা আমাদের আবেগ দ্বারা গঠিত এবং অপরটি হচ্ছে যৌক্তিকতা, যা আমাদের প্রকৃত রূপ। যৌক্তিকতা আমাদের মানসিকতার মানদণ্ড, যেখানে প্রশ্ন ওঠে প্রকৃত মানুষের সংজ্ঞা কী হতে পারে এবং আমাদের মানসিকতা সত্যিই মানুষের প্রকৃত সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে কি না?" বিবর্তন হওয়া প্রাণীকুলে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার মাধ্যমই মানসিকতা, এই মানসিকতা আমরা যার মাঝে দেখতে পাই, তাকেই মহা বিজ্ঞ ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে জ্ঞানে বোধ করি, অনুসরণ করি; কারণ আমরা সবাই প্রকৃত মানুষ হতে চাই। মানুষ হওয়া যায় না, মানসিকতা চর্চা করতে হয়, যে যতদিন এই চর্চা করবে, সে ততদিন মানুষ হিসেবে আখ্যা পাবে আর যখন ভঙ্গ করবে, তখন নিন্দিত হবে অমানুষ হিসেবে। সত্যকে সত্য বলা আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার শিক্ষা আমরা তখনই পাব, যখন বাস্তবতা সম্পর্কে সকল বিশ্বাসকেই আমরা সন্দেহ করতে পারব, যখন মানসিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারব সত্যের সন্ধানে। সভ্যতার বিবর্তন প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে, সংস্কৃতি বিনা কখনো সম্প্রদায় গড়ে ওঠে না, প্রতিটি সংস্কৃতি বিবর্তনের ছোঁয়ায় বিবর্তিত হতে হতে সভ্য হয়ে ওঠে, পরিশেষে সভ্য হয়ে ওঠা উৎকৃষ্ট সংস্কৃতিটুকু অবশ্যই সুন্দরের রুচিবোধ জাগাবে। প্রতিটি সংস্কৃতিকে যার যার জায়গা থেকেই বোধে ধারণ করা উচিত, প্রতিটি সংস্কৃতি এক একটি দর্শন, এক একটি দৃষ্টিকোণ, এক একটি ভাবনার সমাহার। কিন্তু যারা অপর সংস্কৃতিকে অপ বলে জ্ঞান করে, তারা সংস্কৃতির বোধ থেকে সাম্প্রদায়িক নয়, বরং এরাই অধার্মিক। এরাই বাতাসে ছড়ায় ঈর্ষা আর অপ-সংস্কৃতির বীজ, যা ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে সম্প্রীতি অপেক্ষা বিদ্বেষ বেশি জাগায়। আমাদের একটি সোনালী সময় ছিল, সুন্দর সংস্কৃতি ছিল, ছিল ভৈরবীর মতো বোধ, যে বোধ লিঙ্গভেদে ভাবতে শেখায়। ছিল এমন একটি শিক্ষা, যা সকল প্রাণে বা বস্তুতে নিজেকে সমর্পণ করতে শেখায়, যে দৃষ্টি - নগ্নতায় কখনো যৌনতা আবিষ্কার করেনি, এমন একটি পরিবার যেখানে যৌথ বন্ধন বজায় থাকত অটুট: বংশপরিক্রমায়। অথচ এ সংস্কৃতি, এ সুর, এ চর্চা এ অঞ্চলেরই, আমরাই গড়েছি রাগের কাঠামো। বাংলার বায়ুপ্রবাহে আমি শঙ্খসুর শুনতে পাই, যে কণ্ঠ আমার আদিপুরুষের, এ মাটিতে আমি রক্তের ঘ্রাণ পাই, যা আমারই আদি পুরুষদের, যারা ধার্মিক ছিলেন, যারা ধর্মান্তরিত না হওয়ার অভিযোগে খুন হয়েছিলেন এ মাটিতেই, আর এই সমস্ত খুনের উপরই তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আজকের নব্য সভ্য বৈশ্বিক সংস্কৃতি। সংস্কৃতির এই পরিবর্তনের মাধ্যমে যেমন আমরা একটা নব্য সভ্যতা পেয়েছি, এরই সাথে হারিয়ে ফেলেছি অনেক সভ্যতা ও তাদের সংস্কৃতি এবং তাদের সংখ্যার পরিধিটুকুও ছোট নয়। দৃষ্টিতে প্রাণের প্রভাব আমি যা দেখছি, তা আদৌ সত্য নয়, তা কেবলই আমার মনের ধারণা মাত্র। প্রকৃতির যে সকল রূপ, রং ও গন্ধে আমার মন মেতে ওঠে, তা শুধু মাত্র আমার মস্তিষ্কের কল্পনা। প্রকৃতিতে রং নেই, নেই স্বীয় রূপ, গন্ধ বা প্রাণ। আছে শুধু বস্তু জগতের উপাদান। আমার মনই কেবল জড় আর জীবদের আলাদা করছে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে, নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম, কিছু তফাৎ। প্রাথমিক চিন্তনে আমরা গাছদের জড় বলে ভেবেছিলাম, পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হল গাছদেরও প্রাণ আছে এবং এরা নির্জীব নয়, তাদেরও আছে জন্ম-মৃত্যুর চক্রাকার নিয়ম, নিয়তি ও পরিণতি। এরাও জন্মায়, বড় হয়; এদেরও আছে শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বৃদ্ধকাল। জীবনের উদ্দেশ্য পিতামাতার জীবনের শাশ্বত উদ্দেশ্য যেমন হয় সন্তানদের আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলা, এরই মাঝে মানুষের সন্তানেরা সব সময় আদর্শ অপেক্ষা অসৎ হয়ে ওঠে, কারণ মানব পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলা অপেক্ষা 'টিকে থাকার প্রতিযোগিতায়' ব্যস্ত থাকেন বেশি, যে কারণে মানুষ তার সন্তানদের উপর পুরো মনোযোগ দিতে ব্যর্থ। কিন্তু গাছদের জীবন ও বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই কেবল তার সন্তানদের আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলা, যে কারণে গাছদের জাতগত পরিচয় আপন ফল সম্পূর্ণভাবে বহনে সক্ষম। বঙ্কিম আরও ধারণা করতেন যে, গাছদের কেবল তার সন্তানদের আদর্শ রূপে গড়ে তোলা অপেক্ষা ভিন্ন কোনো কাজ নেই, তাদের জীবনের শাশ্বত ও অনন্ত উদ্দেশ্যই যেনো সন্তানদের আদর্শ রূপে গড়ে তোলা - এ যেনো ঈশ্বরের ইচ্ছা বা ঐশ্বরিক নির্দেশনা, যা গাছেরা পালনে বাধ্য। বঙ্কিম হয়তো এরই মাধ্যমে অস্বীকার করছেন গাছদের স্বীয় ইচ্ছাশক্তির প্রভাব, প্রকৃতির যোজন-বিয়োজনে কতটা অটুট বৃক্ষরাজি, পরিবেশে তাদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব ইত্যাদি। প্রকৃতির প্রয়োজনে ভারসাম্য বজায় রাখতে গাছেরা কখনোবা নিজের পাতাদের ঝরিয়ে ফেলে, আগত মুকুলদের কিছু অংশকে বিনষ্ট করে, গায়ে এঁটে থাকা বাকলগুলোকে খসিয়ে দেয়, অতঃপর নব রূপে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে নতুন মৌসুমের নামে। মানুষের নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তনে, বৃক্ষেরা সংগঠিত করে নীরব বিপ্লব, যা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে প্রকৃতিতে এনে দেয় মহামারী, বিপর্যয় এবং তখনই প্রকৃতি মানুষের সমাজে চালায় ত্রাসের রাজত্ব। নিষ্প্রাণে প্রাণের সঞ্চার গাছপালা, ইট, পাথর, মাটি, বায়ু বা আগুন, অচেতন মননে সবই জড়। আবার মনের চৈতন্যে যেনো এরা সবাই প্রাণ। "শৈল্পিক মন নিষ্প্রাণে করে দান, নব প্রাণ" - এটি একটি ডাইমেনশন বা দেখার মাত্রা। যে দৃষ্টিকোণ স্থান পেয়েছে 'তৃতীয় চোখ বা দিব্যদৃষ্টি' শব্দসমূহে। নিষ্প্রাণ শব্দগুচ্ছ একত্রে পরপর সাজালে জ্বালাময়ী বক্তৃতা তৈরি হয়, যা একটি জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে শেখায়, সংগঠিত করে সফল বিপ্লব, প্রতিবাদের ভাষায় শক্তি সঞ্চার করে, তীক্ষ্ণ করে বিচক্ষণতা। অতঃপর প্রাঞ্জলতার প্রতীকী স্বরূপ প্রকাশ পায় লেখাটি, এ যেন একটি লেখা তথা সাহিত্যের প্রাণ, যা সৃষ্টি হয় কোনো শৈল্পিক লেখকের চিন্তনে, এ প্রাণ শক্তি সঞ্চার করে শৈল্পিক পাঠকের মননে। আর, অচেতন পাঠক কিংবা অসার লেখকের কাছে এ পাঠ্য কেবলই নিরর্থক, মৃত ও অচল; অতঃপর তাদের কাছে লেখাটি নিষ্প্রাণ। ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জীব মনে করি, কারণ আমাদের রয়েছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়—দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শ। এই ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমেই আমরা জগৎকে চিনি, বুঝি এবং অনুভব করি। কিন্তু এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় কি সত্যিই জগৎকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট? বিভিন্ন প্রাণীর অসাধারণ ইন্দ্রিয় ক্ষমতাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো কতটা সীমাবদ্ধ, এবং এই সীমাবদ্ধতাই প্রমাণ করে যে জগতের সমস্ত রহস্য মানুষের পক্ষে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। প্রাণীকুলের বিচিত্র ইন্দ্রিয় ক্ষমতা একটি কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষের চেয়ে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১০০,০০০ গুণ বেশি সংবেদনশীল, তারা ক্যান্সারের মতো রোগ শনাক্ত করতে পারে, এমনকি মাটির নিচে চাপা পড়া মানুষকে খুঁজে বের করতে পারে, আমরা যেখানে কেবল একটি গোলাপের সুগন্ধ পাই, একটি কুকুর সেখানে গোলাপের প্রতিটি অণুর আলাদা ঘ্রাণ বিশ্লেষণ করতে পারে। আমাদের চোখে যা কেবল নিছকই বস্তু, একটি বিড়ালের দৃষ্টিতে তার মাত্রা অনেক ভিন্ন, বিড়াল কম আলোতে মানুষের চেয়ে ৬ গুণ ভালো দেখতে পায়, তাদের রেটিনায় রড কোষের সংখ্যা অনেক বেশি, যা তাদের রাতের বেলায় শিকার করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, তাদের দৃষ্টির একটি আলাদা ডাইমেনশন আছে, যেখানে বস্তুর গভীরতা এবং গতিকে তারা আমাদের চেয়ে ভিন্নভাবে অনুভব করে, তাদের চোখে ইউভি (Ultraviolet) আলোও দৃশ্যমান, যা আমাদের চোখে অদৃশ্য। একটি চিল কয়েক কিলোমিটার উপর থেকে মাটির ক্ষুদ্রতম শিকারকেও স্পষ্ট দেখতে পায়, তাদের চোখের গঠন এমন যে তারা অতি দ্রুত বস্তুর গতিবিধি শনাক্ত করতে পারে এবং তাদের ফোকাসিং ক্ষমতা মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি, মানুষের যেখানে একটি নির্দিষ্ট সীমার পর সবকিছু ঝাপসা মনে হয়, চিল সেখানে একই দূরত্বে অনেক বেশি তীক্ষ্ণতা বজায় রাখে। অতীন্দ্রিয় মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরেও প্রাণীকুলে এমন অনেক ইন্দ্রিয় ক্ষমতা বিদ্যমান, যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়, বাদুড় অন্ধকার রাতে চলাফেরা করে এবং শিকার ধরে ইকোলকেশন বা প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে, তারা আল্ট্রাসাউন্ড তরঙ্গ নির্গত করে এবং সেই তরঙ্গের প্রতিধ্বনি শুনে বস্তুর অবস্থান, আকার ও গতিবিধি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে পারে। সাপেরা তাদের জিহ্বা ব্যবহার করে বাতাসের অণু সংগ্রহ করে এবং জেকবসন'স অর্গান নামক এক বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে রাসায়নিক সংকেত বিশ্লেষণ করে শিকারের অবস্থান শনাক্ত করে, কিছু সাপের ইনফ্রারেড দৃষ্টিশক্তিও রয়েছে, যা তাদের অন্ধকারে উষ্ণ দেহের উপস্থিতি টের পেতে সাহায্য করে। কিছু মাছ এবং প্লাটিপাস-এর মতো প্রাণী ইলেকট্রো-রিসেপশন বা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র অনুভব করার ক্ষমতা রাখে, তারা পানির নিচে লুকিয়ে থাকা শিকারের পেশী সংকোচনের ফলে সৃষ্ট ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক সংকেত শনাক্ত করতে পারে, এই ক্ষমতা তাদের ঘোলা পানিতেও শিকার খুঁজে পেতে সাহায্য করে। পরিযায়ী পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে দিক নির্ণয় করে, তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের জৈবিক কম্পাস রয়েছে, যা তাদের হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে সাহায্য করে। জাগতিক ভ্রম এই উদাহরণগুলো থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা যে জগৎকে দেখি, তা জগতের একমাত্র বা চূড়ান্ত রূপ নয় বরং আমরা রং দেখি, কারণ আমাদের চোখে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সংবেদনশীল কোষগুলোকে উদ্দীপিত করে, আমরা শব্দ শুনি কারণ নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের তরঙ্গ আমাদের কানের পর্দায় আঘাত করে, কিন্তু এই রং বা শব্দ কোনো বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণ নয়, বরং আমাদের মস্তিষ্কের তৈরি করা ব্যাখ্যা মাত্র। আমাদের দৃশ্যত জগতের সমস্ত উপাদান আসলে কিছু কোড মাত্র, এই কোডগুলো আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহীত হয় এবং আমাদের মস্তিষ্ক সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে আকৃতি, রং, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি রূপে উপস্থাপন করে। যখন একটি কুকুর একটি নির্দিষ্ট গন্ধ অনুভব করে, তখন তার মস্তিষ্কে যে তথ্য প্রক্রিয়াজাত হয়, তা আমাদের মস্তিষ্কে ভিন্নভাবে হয়, কারণ আমাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় সেই কোডগুলো ভিন্নভাবে গ্রহণ করে। একই বস্তুর আকৃতি, রং ও অন্যান্য বিষয় মানুষ যেভাবে দেখে, বোঝে ও অনুধাবন করে তার ইন্দ্রিয় দ্বারা, ভিন্ন প্রাণিকুল ভিন্নভাবে দেখে, যার মানেটাও ভিন্ন হয় বা হতে পারে। জাগতিক ধারণা জগৎকে পুরোপুরি বুঝতে হলে কেবল মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন জগতের সমস্ত প্রাণীকুলের ইন্দ্রিয় ক্ষমতাকে একত্র করা এবং সবকিছুকে একটি একক সত্তায় ধারণ করা, এই সম্মিলিত ইন্দ্রিয় ক্ষমতা একটি অসীম জ্ঞান ও উপলব্ধির জন্ম দেবে, যা মানুষের পক্ষে ধারণ করা অসম্ভব, এই ক্ষমতা কেবল ঐশ্বরিক। আমরা মানুষ হিসেবে যে জগৎকে জানি, তা কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, অসীম এই জগতের আরও কত রহস্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে, তা নিয়ে ভেবে দেখলেই বোঝা যায় আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। আর তাই নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে ঢাকঢোল পেটানোর কোনো মানেই হয় না, আমাদের আবিষ্কার কেবল নিজেদের মুক্ত পুঁজিবাজারে পণ্যের ঘাটতি পূরণ করা ছাড়া এর বাইরে প্রকৃতি, জগৎ ও জাগতিক প্রাণীকুলের কোনো উপকার হচ্ছে না ক্ষতি ছাড়া। ইলন-মাস্কের মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইট কি কোনো ভাবে সমুদ্রের নীচে থাকা কোনো প্রাণীর কোনো ভাবে উপকারে আসছে? কিংবা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো প্রভাবে ডলারের দাম যেভাবে বেড়ে গেছে এর কোনো প্রভাব কি মানুষ ছাড়া ভিন্ন কোনো প্রাণীর জীবন যাত্রার মানে বিঘ্ন ঘটিয়েছে? ডলারের মূল্য যদি আন্তর্জাতিক বাজারে ১ লক্ষ গুণও বেড়ে যায় তা মানব সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে কিন্তু প্রকৃতির কিছুই আসবে না যাবেও না, এবং ভিন্ন কোনো প্রাণীকুলে এর কোনো প্রভাবও পড়বে না যেদিকে মানব সমাজে দুর্ভিক্ষ দেখাদিবে। এতে এই বিষয়ে আমরা উপনীত হতে পারি যে, শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করা মানুষের এতো আধুনিকায়ন, এতো অর্জন ও আবিষ্কার প্রকৃতির আর কোনো প্রাণীকুলেরই কোনো উপকারে আসছে না, একই সমাজে থেকেও যেনো আমরা কতটা দূরে, যেনো ভিন্ন আরেকটা জগত। এই জগতের রেখাপাত ঘটেছে শুধুমাত্র পুঁজিবাজারের মাধ্যমে, সামুদ্রিক তিমি বা কুকুর বেড়ালও যদি টাকার ব্যবহার করতো, তাহলে ওই সমস্ত আন্তর্জাতিক কারণে তাদেরও জীবন যাত্রার মানে আঁচ লাগত, মানুষের সমস্ত আবিষ্কার, অর্জন ও বহুজাতিক পণ্যের মুক্ত বাজার সুবিধা দিতো। মানুষ যেহেতু এখনও বহুজাতিক পণ্যের মুক্ত বাজারকে পুঁজিবাদ থেকে আলাদা করতে পারছে না, সেহেতু মানুষের এতো অর্জন মানুষ ছাড়া জগতের ভিন্ন কোনো প্রাণীকুলের কিছুই আসছেও না, যাচ্ছেও না। সুতরাং প্রকৃতির কাছে একটা মাছের মূল্য যতটুকু, মানুষের মূল্য তার থেকে বেশি হবার প্রশ্নই উঠে না। একটা পিপীলিকা বেঁচে থাকার ততটাই অধিকার আছে, যতটা অধিকার একটা মানুষ বেঁচে থাকতে দাবী করে। হোক সেটা বস্তু, প্রাণ কিংবা রং, আমরা যত সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতে পারব এদের, ততই বিষদ বিন্যাস আমাদের মস্তিষ্কে আন্দোলিত হবে, ততই বিষদ বিবরণে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা সচেতন হব। সদ্যোজাত মুরগী ছানার একটি দল দেখে মানুষেরা কখনোই প্রতিটা বাচ্চার চেহারাকে আলাদা করতে ব্যর্থ হলেও মা মুরগীর কাছে প্রতিটা বাচ্চাই ব্যক্তিগত ও আলাদা পরিচয় বহন করে। আরেকটা উদাহরণ থেকে বিষয়টি সহজ হতে পারে যেমন, বাঙালিদের কাছে যদি ২০ জন চাইনিজ কিংবা কোরিয়ান মানুষের ছবি ও নামের তালিকা দেয়া হয় যাদের চেহারা আপাত দৃষ্টিতে একই রকম মনে হবে এবং তাৎক্ষণিক ভাবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরিচয় আলাদা করাটা এক প্রকার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু স্বজাতির কাছে তা একদমই সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়, আফ্রিকান নিগ্রো সম্প্রদায়ের বেলায়ও একই যুক্তি সত্য। মানুষের বোধের সীমা আমাদের এই জগৎ কেবল একটি মাত্র স্তরে সীমাবদ্ধ নয়, আমরা যা দেখি, শুনি, স্পর্শ করি—তা কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে, তা কেবল সেইসব তথ্যই গ্রহণ করতে পারে যা আমাদের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন, কিন্তু এই সীমানার বাইরেও জগতের আরও বহু স্তর রয়েছে, যা আমাদের বোধের বাইরে, এই বহুমাত্রিক বাস্তবতা নিয়ে ভাবলে আমরা নিজেদের জ্ঞান ও অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আরও সচেতন হতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, মহাকাশের বিশালতার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এবং অন্যান্য জ্যোতিষ্ক, কিন্তু আমরা যা দেখি, তা হলো দৃশ্যমান আলো। মহাবিশ্বের বেশিরভাগ অংশই ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি দিয়ে গঠিত, যা আমরা দেখতে পাই না, অনুভব করতে পারি না, এগুলি এমন এক ধরনের অস্তিত্ব, যা আমাদের পরিচিত পদার্থ বা শক্তির মতো নয়। কিন্তু এই অদৃশ্য উপাদানগুলোও মহাবিশ্বের গঠন এবং বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে এরা অদৃশ্য হলেও এদের অস্তিত্ব অপরিসীম। তেমনিভাবে, এই পৃথিবীতেও এমন অনেক অস্তিত্ব থাকতে পারে যা আমাদের পরিচিত জীবনের সংজ্ঞার বাইরে। মানুষ কেবল সেইসব প্রাণকে 'প্রাণ' হিসেবে চিহ্নিত করে, যাদের জীবনচক্র, কোষীয় গঠন এবং জৈবিক প্রক্রিয়া আমাদের জানা আছে, কিন্তু এমনও হতে পারে যে, অন্য কোনো প্রাণ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে ভিন্ন উপায়ে, তারা হয়তো এক ধরনের শক্তি বা কম্পনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, যা আমাদের শ্রবণশক্তির সীমার বাইরে, তারা হয়তো তাপ বা রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়, যা আমাদের ঘ্রাণ বা স্পর্শের মাধ্যমে ধরা পড়ে না। এরকম অস্তিত্বগুলো আমাদের কাছে নিষ্প্রাণ মনে হলেও তারা তাদের নিজস্ব জগতে সজীব, আমরা যেমন কোনো পাথরকে নিষ্প্রাণ মনে করি, কারণ তার মধ্যে জীবন বা প্রাণের পরিচিত লক্ষণগুলো নেই, কিন্তু পাথর বা জড় বস্তুর মধ্যেও রয়েছে পরমাণু এবং অণুর এক জটিল জগত, সেই জগতে রয়েছে অবিরাম গতি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, "আমাদের কাছে যা স্থবির, অন্য মাত্রায় তা হয়তো স্পন্দিত।" এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, মানুষ হিসেবে আমাদের জ্ঞান এবং উপলব্ধি অত্যন্ত সীমিত, আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কেবল আমাদের নিজস্ব সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, কিন্তু এই মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে আমাদের সংজ্ঞাগুলি তুচ্ছ। তাই, প্রকৃতির কাছে আমরা এবং অন্য যেকোনো প্রাণীর মূল্য সমান, কারণ আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি এক। প্রতিটি জীবনের, প্রতিটি সত্তার নিজস্ব একটি জগৎ আছে, যা অন্য জগতের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমাদের উচিত এই বহুমাত্রিকতাকে স্বীকার করে সমগ্র প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। বহুমাত্রিক বাস্তবতা মানুষের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান সীমাবদ্ধ, তা কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের বা দর্শনের আবিষ্কার নয়, প্রাচীনকালে মহামানব বুদ্ধও এই সত্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর দর্শনে আমাদের বোধের সীমাবদ্ধতা এবং প্রকৃত বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। বুদ্ধের মতে, আমরা যা দেখি, শুনি, স্পর্শ করি—তা সবই ক্ষণস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই পরিবর্তনশীল জগতের একটি অংশকেই কেবল ধারণ করতে পারে। তিনি এই ধারণাটি তুলে ধরেছেন যে, আমাদের দুঃখের একটি বড় কারণ হলো, আমরা এই ইন্দ্রিয়লব্ধ বাস্তবতাকে চিরন্তন সত্য বলে ভুল করি। আমাদের উচিত এই ক্ষণস্থায়ী বাস্তবতাকে অতিক্রম করে একটি গভীরতর সত্যের অনুসন্ধান করা, যা আমাদের মন ও চেতনাকে প্রসারিত করবে। অন্যদিকে, আধুনিক দর্শনে বার্ট্রান্ড রাসেলও এই একই ধারণাকে ভিন্ন ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় 'প্রকৃত বস্তুর অস্তিত্ব' নিয়ে বিতর্ক তুলে ধরেছিলেন, রাসেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে, আমরা যখন কোনো বস্তু, যেমন একটি আপেল দেখি, তখন আমরা আসলে আপেলটিকে সরাসরি উপলব্ধি করি না, আমরা তার রঙ, আকৃতি, গন্ধ এবং স্পর্শের মতো কিছু 'গুণাবলী' উপলব্ধি করি, এই গুণাবলীগুলো আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের ব্যাখ্যা তৈরি করে। রাসেল প্রশ্ন তোলেন, এই গুণাবলীগুলো কি আপেলের নিজস্ব অংশ, নাকি আমাদের মস্তিষ্কের একটি নিজস্ব ব্যাখ্যা? আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান কেবল একটি আভাস মাত্র, প্রকৃত বাস্তবতা নয়, আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কেবল আমাদের নিজেদের তৈরি করা একটি ক্ষুদ্র জগতের ওপর নির্ভরশীল, যা অন্য প্রাণীর জগৎ থেকে ভিন্ন হলেও কোনো অংশে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমাদের উচিত এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়ে প্রকৃতির প্রতিটি সত্তার প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হওয়া। কারণ এই মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে আমাদের সংজ্ঞাগুলো তুচ্ছ এবং প্রতিটি প্রাণের অস্তিত্বের ভিত্তি একই। মস্তিষ্কের ব্যবহার মানুষ যেমন তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে জটিল প্রযুক্তি, ভাষা এবং সমাজের কাঠামো তৈরি করেছে, অন্যান্য প্রাণীরাও তাদের নিজস্ব উপায়ে তাদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে টিকে থাকছে। যেমন: একটি বাঘ যেমন তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে শিকারের কৌশল তৈরি করে, তেমনই একটি হরিণও তার মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে বাঘের গতিবিধি অনুমান করে নিজেদের রক্ষা করে, উভয়েরই টিকে থাকার জন্য নিজস্ব কৌশল আছে, এবং কেউই অন্যটির চেয়ে কম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় না। মৌমাছি বা পিঁপড়ারা এক জটিল সামাজিক কাঠামো তৈরি করে, তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে খাবার খুঁজে বের করে, বাসা তৈরি করে এবং তাদের কলোনির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, এই ধরনের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা মানুষের থেকে ভিন্ন হলেও, তাদের টিকে থাকার জন্য এটি অপরিহার্য। এ থেকে বোঝা যায়, প্রতিটি প্রাণীর মস্তিষ্ক তার নিজস্ব পরিবেশ এবং প্রয়োজনের সাথে মানিয়ে চলার জন্য বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছে। মানুষ যেমন এক ধরনের পরিবেশে টিকে আছে, অন্য প্রাণীরাও তাদের নিজস্ব পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করছে। স্বতন্ত্র জগৎ একই সমাজে একাধিক প্রাণীর জগৎ আলাদা, যদিও আমরা প্রায়শই মনে করি যে, আমরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু টিকে থাকার মূল লড়াইয়ে প্রতিটি প্রাণীই স্বতন্ত্র। মানুষ তার অস্তিত্বের জন্য অন্য প্রাণীদের ওপর নির্ভরশীল (যেমন খাদ্যের জন্য), কিন্তু একটি সিংহ বা একটি ডলফিনের টিকে থাকার জন্য মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের জগৎ পুঁজিবাজার, যুদ্ধ এবং প্রযুক্তিনির্ভর, কিন্তু একটি কুকুরের জগৎ তার ঘ্রাণ, তার চারপাশের মানুষের আচরণ এবং তার খাবারের উপর নির্ভরশীল, এই দুটি জগৎ একই স্থানে অবস্থান করলেও তাদের বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। অদৃশ্য ও নিষ্প্রাণ অস্তিত্ব এমন অনেক প্রাণী থাকতে পারে যাদেরকে আমরা প্রাণ হিসেবে শনাক্ত করতে পারি না, মানুষের ইন্দ্রিয় সীমিত, তাই আমরা কেবল সেইসব প্রাণীকেই উপলব্ধি করতে পারি যাদের অস্তিত্ব আমাদের ইন্দ্রিয়ের সীমার মধ্যে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ: ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের মতো অতি ক্ষুদ্র প্রাণীদের অস্তিত্ব আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, তাদের প্রাণ হিসেবে শনাক্ত করতে আমাদের অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়, অতীতে যখন এই প্রযুক্তি ছিল না, তখন মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতও না। আমাদের চারপাশে এমন প্রাণ রয়েছে যাদের গঠন বা অস্তিত্ব আমাদের পরিচিত কোনো প্রাণীর মতো নয়, হতে পারে তারা এক ধরনের শক্তি বা কম্পনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে, যা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা ধরা পড়ে না। আমরা যা দেখি বা অনুভব করি, তা-ই একমাত্র বাস্তবতা নয়, এই বিশ্বের আরও অনেক রহস্য রয়েছে যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুতরাং, প্রতিটি প্রাণীই নিজেদের টিকে থাকার জন্য তাদের মস্তিষ্ককে সমানভাবে ব্যবহার করছে, কিন্তু তাদের পন্থা ভিন্ন, এই ভিন্নতার কারণেই একই সমাজে থেকেও প্রত্যেকের জগৎ আলাদা। পুঁজিবাদের জালে আবদ্ধ মানবতা মানুষের প্রতিটি আবিষ্কার, প্রতিটি অর্জন যেন এক নিপুণ জালে বন্দী, এই জালের নাম পুঁজিবাদ। আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাই, সমুদ্রের গভীরে সাবমেরিন চালাই, পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগাই, কিন্তু এই সবকিছুর পেছনে একটাই উদ্দেশ্য—অর্থনৈতিক মুনাফা ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য। এই আবিষ্কারগুলো আমাদের জীবনকে আরও আরামদায়ক, আরও সুবিধাজনক করেছে, কিন্তু এই আরাম আর সুবিধা কেবল মানুষের জন্যই। ইলন মাস্কের স্পেসএক্স রকেট যখন মহাকাশে উড়ে যায়, তা আমাদের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জিপিএস প্রযুক্তির নিশ্চয়তা দেয়। এর ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক লেনদেন, এবং বিনোদন আরও গতিশীল হয়। কিন্তু এই রকেটের জ্বালানি থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলের যে ক্ষতি করে, তার ফল ভোগ করে সমগ্র জীবজগৎ। সমুদ্রের গভীরে থাকা কোনো ডলফিনের জীবনে এই স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সামান্যতম পরিবর্তনও আনে না, বরং মহাসাগরের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় তার জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদের এই চক্রে ফেঁসে মানুষ প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আমাদের সামাজিক কাঠামোর উন্নয়ন আর একদল পিঁপড়ের কলোনি নির্মাণের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। পিঁপড়ারা তাদের কলোনির জন্য কাজ করে, খাদ্য সংগ্রহ করে, নিজেদের জীবন টিকিয়ে রাখে—সবটাই তাদের গোত্রীয় স্বকীয়তা ও টিকে থাকার লড়াইয়ের জন্য। একইভাবে, আমরাও আমাদের সমাজের উন্নয়নে কাজ করি, প্রযুক্তি তৈরি করি, অর্থনীতির চাকা সচল রাখি। উভয়ই নিজ নিজ সেবায় নিয়োজিত, নিজ নিজ পরিবেশে সমান ব্যস্ত, সমান কর্মঠ এবং স্বতন্ত্র। কিন্তু মানুষ এই স্বতন্ত্রতার সীমা ছাড়িয়ে বারবার নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে চেয়েছে। আর এই শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়ে সে কেবল নিজেদের উন্নতিই করেনি, বরং নির্বিচারে পরিবেশ ও অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষতি করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, আমাজন জঙ্গলের কথা যদি ভাবি, মানুষের কাছে এটি কেবল কাঠ, খনিজ সম্পদ বা কৃষিজমির উৎস। কিন্তু আমাজন আসলে পৃথিবীর ফুসফুস, যা লাখ লাখ প্রজাতির প্রাণীর আশ্রয়স্থল। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাপে মানুষ নির্বিচারে সেই বন উজাড় করে চলেছে, যার ফলে অসংখ্য প্রাণী তাদের আশ্রয় হারাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং সমগ্র পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের ফলে মানুষের সাময়িক অর্থনৈতিক লাভ হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্যই বিপদ ডেকে আনছে। মানুষের কোনো আবিষ্কার, সেবা বা জাগতিক উন্নতি যদি প্রকৃতি এবং সমাজের ভিন্ন প্রাণীদের প্রভাবিত করতে না পারে, তবে তা কি সত্যিই সার্থক? যদি আমাদের প্রযুক্তি এমন এক কৃত্রিম জগৎ তৈরি করে, যেখানে প্রকৃতি কেবল একটি সম্পদ, আর অন্যান্য প্রাণীরা কেবল ভোগের উপাদান, তবে আমাদের এই তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কি নিছকই নিরর্থক নয়? এই প্রশ্নগুলো আমাদের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। মানুষের সমস্ত অর্জন, সমস্ত উন্নতি যেন একতরফা। একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা উচ্চগতির ট্রেন মানুষের জীবনকে সহজ করতে পারে, কিন্তু এই প্রযুক্তিগুলো প্রকৃতি ও অন্যান্য প্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই প্রযুক্তি তৈরির জন্য যে খনিজ সম্পদ আহরণ করা হয়, যে কারখানাগুলো দূষণ ঘটায়, তার ফল ভোগ করে সবাই। অথচ এই প্রযুক্তির সুবিধা কেবল মানুষই উপভোগ করে। আমাদের উচিত এই বোধকে জাগ্রত করা যে, প্রতিটি প্রাণের বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের মতোই সমান। একটি পিঁপড়ে বা একটি মাছের মূল্য কোনো মানুষের চেয়ে কম নয়। আমাদের প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব তখনই প্রমাণিত হবে, যখন আমরা নিজেদের আবিষ্কার ও উন্নতির সুফল কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমগ্র প্রকৃতির কল্যাণে ব্যবহার করতে পারব। আমাদের আধুনিকায়ন যেন বিচ্ছিন্নতার কারণ না হয়ে, বরং প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার মাধ্যম হয়। ক্ষমতার ফাঁদ এবং বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতি ইতিহাসের পাতায় জিন্নাহর চোখে শেখ মুজিব ছিলেন এক ‘গাদ্দার’। কেন? কারণ তিনি সেই সময়ের জ্বলন্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম লীগের আদর্শ থেকে ‘পল্টি’ মেরেছিলেন। কিন্তু এই পল্টি কি কেবল ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভ ছিল? না কি এটি ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি? জিন্নাহর দৃষ্টিতে যা ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, মুজিব তার রাজনৈতিক কৌশল আর গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে তাকে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারছে না। তাই তিনি সেই অসন্তোষকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে নিজেকে মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে মহানায়ক হয়ে ওঠার পরও তিনি ক্ষমতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। স্বাধীনতা এনে দেওয়ার পর যখন তার হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা আসে, তখন তিনি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে নিজের সহজাত চরিত্রের আসল রূপটি দেখান। এটি প্রমাণ করে যে, একজন নেতা যত বড়ই আদর্শের কথা বলুক না কেন, ক্ষমতা হাতে পেলে তার আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। শেখ মুজিবও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। এটিই রাজনীতির কদর্য খেলা, যেখানে মহানায়কের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ক্ষমতালিপ্সু এক স্বৈরাচারী। বিপ্লবের বীজ এবং আদর্শের পতন তৎকালীন পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ছিল এতটাই জ্বালাময়ী যে, ‘বিপ্লব’ হতোই। শেখ মুজিব নেতৃত্ব না দিলেও হয়তো তা বিশৃঙ্খলভাবে হলেও ঘটতো। কারণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি কেবল ভৌগোলিক দূরত্বই তৈরি করেনি, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বীজও বপন করেছিল। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দল, যেমন বামপন্থী সংগঠন, ছাত্র সমাজ এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা সেই বীজ বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখানে শেখ মুজিবের বিচক্ষণতা ছিল এই যে, তিনি সেই বিচ্ছিন্নতার বীজকে একটি সুসংহত রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তর করতে পেরেছিলেন। তিনি কেবল ক্ষমতার হাতবদল চাননি, চেয়েছিলেন একটি নতুন রাষ্ট্র। কিন্তু সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সমাজতন্ত্রের আদর্শ ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ক্ষমতা নতুন করে কুক্ষিগত হয় একদল পুঁজিবাদের ধারক-বাহকদের হাতে। এর ফলে, যে শোষণ থেকে বাঙালি মুক্তি চেয়েছিল, তা এক নতুন রূপে আবার ফিরে আসে। এটিই ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস—যে বিপ্লব আদর্শের জন্য শুরু হয়, তা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার হাতবদলের এক খেলায় পরিণত হয়। উপেক্ষার জ্বালা এবং নাথান বমের উত্থান আজকের বাংলাদেশে আমরা সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি। উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর প্রতি আমাদের রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও সামাজিক বৈষম্য তাদের মধ্যে এক গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। আমরা যখন উপজাতি মেয়েদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য অর্জন করতে দেখি, তখন আনন্দে উদ্বেলিত হই। কিন্তু তাদের জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতি, ভূমির অধিকার এবং মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো আমরা অস্বীকার করি। এই দ্বৈত মানদণ্ডই নাথান বম কুকি চীনের মতো সশস্ত্র বিপ্লবীদের জন্ম দেয়। নাথান বম কি তাহলে শেখ মুজিবের মতোই তাঁর সম্প্রদায়ের বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়ছেন না? তিনি কি তাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পরিচয় ও স্বাধিকারের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন না? শেখ মুজিব এবং নাথান বমের মাঝে একটি বেদনাদায়ক সমান্তরাল রেখা টানলে দেখা যায়, উভয়েই রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। পার্থক্য শুধু এই যে, একজন সফল হয়ে আমাদের কাছে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন, আর একজন এখনও সফল হননি বলে আমাদের কাছে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু তাদের দুজনেরই মূল প্রেরণা হলো ক্ষমতার লোভ—একজনের ক্ষমতার লোভ এক জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, অন্যজনের ক্ষমতার লোভ মিশেছে একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বঞ্চনার সঙ্গে। ক্ষমতার চক্রব্যূহ এবং অনিবার্য পরিণতি কেবল ক্ষমতার হাতবদল কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে না। যতক্ষণ না রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন হয় এবং রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ করে, ততক্ষণ বিদ্রোহের বীজ ছড়াতেই থাকে। শেখ মুজিব যদি তার ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর বাকশাল কায়েম না করতেন, তাহলে হয়তো তার আদর্শের প্রতি বিশ্বাস আরও অটুট থাকত। নাথান বমও যদি তার লড়াইয়ে সফল হন, তবে তিনিও একই পরীক্ষার মুখোমুখি হবেন—ক্ষমতার লোভকে জয় করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। ইতিহাস আমাদের বারবার এই শিক্ষাই দেয় যে, ক্ষমতা একটি ফাঁদ। বিপ্লবীরা সেই ফাঁদে পা দেয়, কিন্তু খুব কম বিপ্লবীই তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। শেখ মুজিবও বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাই নাথান বমের উত্থান শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং আদর্শের পতন থেকে উদ্ভূত এক অনিবার্য পরিণতি। কোম্পানির শাসন থেকে দেশীয় পুঁজিবাদ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করে। সেই কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের আগে যে স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল, তার মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশি শোষণ থেকে মুক্তি। সে সময় দেশীয় বণিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষ কোম্পানির নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেই আন্দোলন কেবল কোম্পানিকে বিতাড়িত করার জন্য ছিল না, বরং তা ছিল একটি মুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও সেই স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, ক্ষমতার হাতবদলের পর আমরা দেখলাম, বিদেশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থান দখল করে নিয়েছে দেশীয় পুঁজিপতি কোম্পানিগুলো। একাত্তরের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পের পাশাপাশি দেশীয় পুঁজিপতিদের উত্থান ঘটে। এই দেশীয় কোম্পানিগুলো বিদেশি কোম্পানির মতোই মুনাফার জন্য শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে শোষণ করা শুরু করে। এই শোষণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এই দেশীয় পুঁজিবাদী কোম্পানিগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। রাষ্ট্রীয় পুলিশ, র‍্যাব এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো অনেক সময় এই কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। যখন শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে, তখন তাদের দমন করা হয়। যখন দরিদ্র কৃষক তাদের জমি রক্ষা করতে চায়, তখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী কোম্পানির পক্ষ হয়ে তাদের উচ্ছেদ করে। এটি কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের নতুন সংস্করণ নয়? তখন ব্রিটিশ সেনারা কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করত, আর এখন আমাদেরই দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশীয় পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করছে। এখানেই রাজনীতির সেই বিশেষ কৌশলটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে: ক্ষমতার হাতবদলের জন্য সুন্দর গল্প ফাঁদতে পারাটাই যেন রাজনীতির বিশেষ ও যুগান্তকারী কৌশল। ১৭৫৭ সালে কোম্পানিকে বিতাড়িত করার জন্য যে স্বাধীনতার গল্প বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে দেশভাগের জন্য সেই একই ধরনের গল্প বলা হয়। আবার ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে গল্প বলা হয়েছিল, তা ছিল দেশের সাধারণ মানুষকে একত্রিত করার এক অসাধারণ কৌশল। কিন্তু এসব গল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাকে এক হাত থেকে আরেক হাতে তুলে দেওয়া। দেশীয় পুঁজিপতিরা এই গল্পের আড়ালে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, আর রাষ্ট্র তাদের সেই সাম্রাজ্যের পাহারাদার হিসেবে কাজ করছে। তাই বলা যায়, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কেবল ক্ষমতার হাতবদল। এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানির শাসন, এক শোষক থেকে আরেক শোষকের আগমন। এই চক্র ভাঙতে না পারলে, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কেবল কথার কথা হয়েই থাকবে। পুঁজিবাদের বিষবৃক্ষ এবং শোষণের নতুন রূপ "ব্যাংকে জমা থাকে সাধারণ জনগণের টাকা আর সেই টাকা লোন নিয়ে একজন গড়ে তুলে কোম্পানি, তাহলে সেই কোম্পানির মালিক কিকরে একজন হয়?" এটি পুঁজিবাদের একটি মৌলিক দ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে আসে। জনগণের টাকায় ব্যাংক চলে, সেই টাকা লোন নিয়ে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। অথচ এই কোম্পানির মালিকানা পুরোপুরি সেই ঋণগ্রহীতার হাতেই থাকে। জনগণের যে অর্থ এই কোম্পানির মূল ভিত্তি, সেই অর্থের উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার থাকে না। এই কোম্পানি যখন শ্রমিকদের শ্রমে পরিচালিত হয়, তখনো সেই শ্রমিকদের এই কোম্পানির মালিকানায় কোনো অংশ থাকে না। ফলে দেখা যায়, জনগণের টাকা এবং শ্রমের উপর ভিত্তি করে একজন ব্যক্তি রাতারাতি বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়, অথচ যারা এই সম্পদের প্রকৃত উৎস, তারা থাকে বঞ্চিত। এটিই হলো পুঁজিবাদের মূল কৌশল—সাধারণ মানুষের সম্পদ ও শ্রমকে ব্যবহার করে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে পুঁজি জমা করা। পোশাক শিল্পের সাফল্য বনাম শ্রমিকের দুরবস্থা বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। কিন্তু এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে লাখ লাখ শ্রমিকের রক্ত, ঘাম এবং অশ্রু। শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান, সুস্বাস্থ্য বা নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাদের যে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হয়, তার বিনিময়ে তারা যে মজুরি পায়, তা দিয়ে তাদের পক্ষে জীবন ধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ তাদের পরিশ্রমে উৎপাদিত পণ্য যখন উন্নত বিশ্বে চড়া মূল্যে বিক্রি হয়, তখন সেই মুনাফা গিয়ে জমা হয় কোম্পানির মালিকের পকেটে। বছরের পর বছর ধরে এই শোষণ চলতে থাকে। একজন শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা তাই ঘোরে না, তারা কেবল বেঁচে থাকার দায়ে টিকে থাকে। নিজেদের সন্তানদের স্কুলে পড়ানোর সাহসটুকুও তাদের থাকে না। ফলস্বরূপ, অধিকাংশ শ্রমিক তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠাতে বাধ্য হয়, যেখানে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। উন্নত চিকিৎসা বা ন্যূনতম মানবিক সুবিধা তাদের কাছে এক অলীক স্বপ্ন। ক্ষমতার দম্ভ এবং আইনের চোখে অন্ধত্ব একদিকে যখন শ্রমিকেরা শোষিত হয়ে টিকে থাকে, অন্যদিকে কোম্পানির মালিকের ছেলে-মেয়েরা রাতারাতি বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ পায়। তাদের কাছে সমাজের নিয়ম-কানুন, নৈতিকতা বা মানবিক মূল্যবোধ অর্থহীন হয়ে যায়। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে একজন শ্রমিককে পিষে দিয়ে চলে যাওয়ার মতো ঘটনা যখন ঘটে, তখন আইন, বিচার এবং বিবেক সবকিছুই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। এই ক্ষমতাবানদের সন্তানদের জন্য আইন অন্ধ। পুলিশ, আদালত, এবং পুরো বিচার ব্যবস্থা টাকার কাছে নিজেদের নৈতিকতা বিক্রি করে দেয়। যে শ্রমিকের সন্তানকে স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য নেই, সেই শ্রমিক যখন পুঁজিবাদের দম্ভের শিকার হয়, তখন তাকে ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের সমাজে স্বাধীনতা কেবল ক্ষমতার হাতবদলই ঘটায়নি, বরং পুঁজিবাদের নামে এক নতুন ধরনের শ্রেণিবিভাজন তৈরি করেছে, যেখানে আইন এবং বিচারও শোষকের পক্ষে কাজ করে। শোষণের চক্র এবং ভাঙার অনিবার্যতা এই পুরো আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ব্রিটিশ কোম্পানি থেকে দেশীয় পুঁজিবাদের হাতে ক্ষমতার হাতবদল হলেও শোষণের প্রক্রিয়া বদলায়নি। বরং তা আরও সূক্ষ্ম এবং ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ব্যাংক, শিল্প, আইন এবং সমাজ—সবকিছুই এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে একজন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ জমা হবে এবং শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ শোষিত হতে থাকবে। এই চক্র যদি ভাঙা না যায়, তবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কেবল কিছু মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাপনের একটি উপায় হয়েই থাকবে।

Comments

Popular posts from this blog

যাপনে জীবনের প্রভাব

Get 5000 followers at fast starting your facebook page | best tips and trick 2023